ট্রাক-বাসসহ পরিবহনকে পুঁজি করে দেশে মাদকের কারবার হচ্ছে। বেশি উপার্জনের লোভে পড়ে অনেক চালক-হেলপার ইয়াবার চালান পৌঁছে দেওয়ার কাজে জড়িয়েছেন। জেনে-বুঝে যারা নিজেদের মালিকানাধীন পরিবহন মাদক কারবারে ব্যবহারের সুযোগ দিচ্ছেন তাদের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি রাখা হচ্ছে। তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।অভিনব কায়দায় ট্রাকের তেলের সিলিন্ডারের মধ্যে ইয়াবা পাচারকালে এক লাখ ৯০ হাজার পিস ইয়াবাসহ পাচারচক্রে জড়িত তিনজনকে গ্রেপ্তারের পর এসব তথ্য জানিয়েছে র্যাব।
গ্রেপ্তাররা হলেন, চট্টগ্রামের বাসিন্দা আমিনুল ইসলাম (২৬) ও হেদায়েত উল্লাহ (২০) এবং বান্দরবানের লামার মো. নুরুল ইসলাম (৪৮)।শনিবার (৬ আগস্ট) রাতে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থেকে মাদক পরিবহনে ব্যবহৃত ট্রাকসহ (ঢাকা মেট্রো-ট-১৩-৫৪২৮) ওই তিনজনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব-১ এর একটি দল। উদ্ধারকৃত মাদকদ্রব্যের বাজার মূল্য প্রায় ৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা।রোববার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, মাদক কারবার চক্রটি টেকনাফ হতে ইয়াবা রাজধানী ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও টাঙ্গাইলসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দিত। জব্দ ট্রাকটির মালিক পলাতক সোহেল। তিনিই এই চক্রের প্রধান আসামি। গত ৪-৫ বছর যাবত চক্রটি পরিবহন ব্যবসার আড়ালে টেকনাফ হতে দেশের বিভিন্ন স্থানে ইয়াবা পাচার কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল।মাদক কারবারে বেশি টাকার প্রলোভনে পরিবহন হেলপার-চালকদের ব্যবহারচক্রটি পণ্যবাহী পরিবহনের চালক-সহকারীকে মোটা অংকের টাকার প্রলোভন দেখিয়ে তাদের গাড়িতে ইয়াবার চালান পরিবহনের জন্য প্রলুব্ধ করে থাকে। ইয়াবা পাচার চক্রের সদস্য সংখ্যা ৭-৮ জন। ট্রাক মালিক সোহেল ও গ্রেপ্তারকৃত আমিনুল টেকনাফের সিন্ডিকেট হতে ইয়াবা সংগ্রহ করে। ইয়াবা সংগ্রহের পর সোহেলের নির্দেশনায় গ্রেপ্তার আমিনুল দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দেয়।
চকরিয়ার গ্যারেজে তেলের সিলিন্ডারে ইয়াবা ঢুকিয়ে ঝালাই
গ্রেপ্তাররা জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, ইয়াবার কারবারে জড়িত চক্রটি তিনটি ভাগে কাজ করে। একটি ইয়াবার সাপ্লাই। আরেকটি গ্রুপ গাজীপুরে পৌঁছে দেয়। আরেকটি গ্রুপ ক্রেতাদের পৌঁছে দেয়।প্রথমে কক্সবাজারের চকরিয়ায় একটি গ্যারেজে বিশেষ পদ্ধতিতে গাড়ির তেলের সিলিন্ডারের মধ্যে গোপন প্রকোষ্ঠ তৈরি করে তার মধ্যে ইয়াবা লুকিয়ে পরিবহন করা হয়। এভাবে অভিনব কায়দায় তেলের ট্যাংকিতে ইয়াবা রাখার পর সোহেল, আমিনুল ও নুরুল ইসলাম প্রথমে ট্রাক নিয়ে টেকনাফ হতে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করে। চট্টগ্রাম আসার পর সোহেল গাড়ি থেকে নেমে যায়।এরপর আমিনুল, নুরুল ইসলাম ও হেদায়েতকে নিয়ে চট্টগ্রাম হতে গাজীপুরের উদ্দেশে রওয়ানা করে। সীতাকুণ্ড ও কুমিল্লায় যাত্রা বিরতি করে। ইয়াবার চালানটি তারা গাজীপুরে সরবরাহের উদ্দেশে যাত্রা করে। তাদের ট্রাকে অন্য কোনো মালামাল ছিল না। পথিমধ্যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন চেকপোস্টে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তারা জানায়, গাজীপুর হতে মালামাল লোড করে চট্টগ্রাম নিয়ে আসার জন্য তারা খালি ট্রাক নিয়ে গাজীপুর যাচ্ছে। ট্রাকের তেলের ট্যাংকিতে ইয়াবাগুলো লুকিয়ে রাখায় তারা নিশ্চিত ছিল যে, তল্লাশিতে ধরা পড়বে না।ইয়াবার চালানে ডিলারদের বিশেষ কোড ব্যবহারজিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, পাশের দেশ হতে ইয়াবা টেকনাফের ডিলারের কাছে আসে। টেকনাফের ডিলার ও ঢাকার ডিলারের পরিকল্পনামত ইয়াবা বিভিন্ন সংখ্যায় চাহিদা অনুযায়ী প্রতিটি প্যাকেটের গায়ে বিশেষ কোড নম্বর দিয়ে প্যাকেটজাত করে থাকে। এই কোড নম্বর দেখেই ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানের ডিলাররা বিভিন্ন মাদককারবারিদের নিকট চাহিদা অনুযায়ী চালান পৌঁছে দিয়ে থাকে। মাদক কারবারিদের ৩/৪ ডিজিটের তিন ধরনের কোড নম্বর পেয়েছি।
গ্রেপ্তার ট্রাক হেলপার আমিনুলগ্রেপ্তার হওয়া আমিনুল পেশায় ট্রাক হেলপার। পড়াশুনা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। চট্টগ্রাম ট্রাকস্ট্যান্ডে মাদক কারবারি ও ট্রাক মালিক সোহেলের সঙ্গে পরিচয় হয়। সোহেলের প্ররোচনায় আমিনুল কক্সবাজার হতে ঢাকাগামী ট্রাকে হেলপারের কাজ শুরু করে। গত ৪-৫ বছর যাবত ইয়াবা পাচারে কাজ করছে আমিনুল। নিজে ট্রাকের হেলপার হিসেবে উপস্থিত থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ইয়াবা পৌঁছে দিতে ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করছিল আমিনুল। চালান প্রতি ৩০-৫০ হাজার টাকা পেত আমিনুল। এর আগে দুই দফায় সোয়া দুই বছর মাদক মামলায় জেল খেটেছেন আমিনুল।মালামাল লোড-আনলোড করতে গিয়ে ইয়াবার কারবারে নুরুলনুরুল ইসলাম বান্দরবান এলাকায় মালামাল পরিবহনের মাধ্যমে সোহেলের সঙ্গে পরিচয়। ট্রাক মালিক সোহেলের সহযোগিতায় সে ইয়াবা পরিবহন ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত হয়। দুইদিন আগে ইয়াবা পরিবহনের উদ্দেশে সোহেল ও নুরুল টেকনাফ যায়। তখন আমিনুল ও হেদায়েত গাড়িতে হেলপার হিসেবে ছিলেন। টেকনাফের সিন্ডিকেট হতে ইয়াবা সংগ্রহের পর ট্রাকের তেলের ট্যাংকিতে ইয়াবা বহন করে নুরুল ও সোহেল খালি ট্রাক চালিয়ে চট্টগ্রামে নিয়ে আসে। অতঃপর সোহেল গ্রেপ্তার আমিনুলকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে চট্টগ্রামে নেমে যায়। এরপর চট্টগ্রাম হতে নুরুল ও হেদায়েত পালাক্রমে গাড়ি চালিয়ে ঢাকা পর্যন্ত নিয়ে আসে।নুরুলের গাড়ি চালনায় কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ নেই। এমনকি তার ভারি যানবাহন চালনার কোনো বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। ট্রাকের হেলপার হিসেবে মালামাল লোড আনলোড করতে গিয়ে গাড়ি স্বল্প দূরত্বে স্থানান্তর করার মাধ্যমে ড্রাইভিং শিখেছেন। গত ১০ বছর ধরে তিনি বিভিন্ন ধরনের পরিবহন চালিয়ে আসছেন। মাদকের একটি চালান পৌঁছে দিয়েই তিনি পেতেন ৫০ হাজার টাকা।টেম্পুচালক থেকে ইয়াবার কারবারে হেদায়েতটেম্পুচালক হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করতেন তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করা হেদায়েত। নিজের নেই বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স। সোহেল ও হেদায়েতের উভয়ের বাড়ি চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে হওয়ায় এলাকার বন্ধুদের মাধ্যমে তার সোহেলের সাথে পরিচয় হয়। অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের আশায় সে সোহেলের সাথে মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। সোহেলের বিশ্বস্ত হওয়ায় মাদক বহনের সময় তিনি গাড়ির চালক ও হেলপার উভয় ভূমিকা পালন করে থাকেন। মাদকের একটি চালান পৌঁছাতে পারলে তিনি ১৫-২০ হাজার টাকা পেতেন।যে গ্যারেজে ট্রাক মডিফাই করে তেলের সিলিন্ডারে ইয়াবার চালান ঢুকানো হয়েছে তাদের ব্যবহারে কি ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে- জানতে চাইলে কমান্ডার মঈন বলেন, মূলহোতা সোহেল পলাতক। তাকে গ্রেপ্তারে চেষ্টা চলছে। তাকে গ্রেপ্তার করতে পারলে পুরো চক্র সম্পর্কে জানা যাবে।
র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাদকবিরোধী অভিযানের মধ্যেও কীভাবে ইয়াবা আসছে? এটা ব্যর্থতা কিনা- জানতে চাইলে র্যাব মুখপাত্র বলেন, ২০১৮ সালে মাদকবিরোধী অভিযানে নামে র্যাব। এটা কিন্তু সামাজিক যুদ্ধ। সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু মাদক প্রতিরোধের কাজ শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নয়। মাদককে ঘৃণার মানসিকতা তৈরিতেও সামাজিক কর্মসূচি বা পদক্ষেপ চলমান রয়েছে। তিনি বলেন, মাদকে যারা জড়িত তাদের আমরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে চাই। এতো কিছুর পরও মাদক আসছে। বন্ধ হচ্ছে না। শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে মাদকমুক্তি সম্ভব নয়। যারা পরিবহন সেক্টরে আছেন তাদের সচেতন হতে হবে। যাতে তাদের পরিবহন মাদকের কারবারে ব্যবহার না হয়। মাদক পরিবহনে চালক হেলপাররা ৫/৭ হাজারের বিপরীতে ৫০ হাজার টাকা পাচ্ছেন। সবাইকে মাদকের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। যদিও অপকৌশল কিন্তু বন্ধ নেই। পাকস্থলীতে করেও এখন কারবারিরা মাদক পরিবহন করছেন।